শহীদ মোবারকের মায়ের মুখে ইফতারি ওঠে না

মোবারক ছোট হলেও সব রোজা রাখত। সাহ্‌রিতে বন্ধুদের সঙ্গে ডেকে তুলত এলাকাবাসীকে। হাঁক দিত– ‘জাগো মুসলমান, ঘুমাইও না আর।’ প্রতিদিন সাহ্‌রিতে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি হাঁক শোনার। কিন্তু আমার মোবারক আর আসে না।”

কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ফরিদা বেগম। এবারের রমজান তাঁর পরিবারে নিয়ে এসেছে বিষাদের ছায়া। গত বছর ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারায় মোবারক হোসাইন।

গত মঙ্গলবার রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বক্স কালভার্ট রোডে মোবারকের ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল, মেয়েদের নিয়ে ফরিদা বেগম ইফতারি প্রস্তুত করছেন। তৃতীয় রোজার ইফতারে এসেছেন তিন মেয়ে, তাদের স্বামী ও সন্তানরা। নাতি-নাতনিসহ সবাইকে নিয়ে ইফতারে বসলেও নেই ঘরজুড়ে কোনো আনন্দ। ফরিদার পাশে বসা বড় বোন রত্না আক্তার বললেন, ‘আমরা সবাই আছি, নেই শুধু মোবারক!’
মোবারকের মৃত্যুর পর থেকে কোনো আনন্দের উপলক্ষ পরিবারটিকে ছুঁতে পারে না। ইফতারে ছোলা-মুড়ি, পেয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, শরবত, ফলমূল থাকলেও, মা-বোনের চোখে ভর করেছে ছোট্ট মোবারকের স্মৃতিমাখা জল।

চোখের পানি মুছতে মুছতে ফরিদা বলেন, ‘আমি এখনও সাহ্‌রিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আমার মোবারক আর কাউকে ডাকে না।’ কথার ফাঁকে মসজিদের মাইকে ভেসে আসে মাগরিবের আজান। কিন্তু মোবারকের মায়ের মুখে উঠছে না ইফতার। তরতাজা সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে অঝোরে কাঁদেন তিনি।

বাবা রমজান আলী বলছিলেন, ‘আমার মতোই মোবারকের জন্ম পবিত্র রমজানে। আমার নাম রমজান হওয়ায় ছোট ছেলের নাম রাখি মোবারক হোসাইন। টিভিতে মাহে রমজানুল মোবারক বলামাত্র আমার ছেলে বলত, আব্বু দেখ তোমার আর আমার নাম বলছে।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় বলতাম– রমজান চলে গেলেও মোবারক থেকে যাবে। কারণ ঈদ এলে সবাই বলবে ঈদ মোবারক। কিন্তু আল্লাহর কী লিখন, মোবারকই আগে হারিয়ে গেল। রয়ে গেলাম রমজান।’

আরও পড়ুনঃ ধনগাজী মিয়াজী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে লক্ষ্মীপুরের বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ
রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোড় থেকে হাতিরপুলের দিকে এগোলে ডান পাশে একটি গলি। সেখানে উঁচু উঁচু ভবন থাকলেও চোখ আটকে যাবে একটি জায়গায়, যেখানে রয়েছে ৩০টি দুধের গাভি, বাঁশ ও কাঠের কাঠামোয় তৈরি টিনের একসারি ঘর। এসব ঘরের দোতলায় থাকে খামারি পরিবারগুলো।

মোবারককে নিয়ে একটি ঘরে থাকতেন রমজান আলী ও ফরিদা বেগম। সেখানে আরেকটি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাদের বড় ছেলে রতনের বসবাস। তিন মেয়ে রত্না আক্তার, আয়েশা আক্তার স্বপ্না ও ফাতিহা আক্তার মিনার বিয়ে দিয়েছেন। অত্যন্ত চঞ্চল মোবারক খেলাধুলা পছন্দ করত বলে জানান রমজান।

মোবারকের স্মরণে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কলাবাগান শাখার নেতারা ফেব্রুয়ারিতে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ছাড়ে। ফাইনাল খেলার দিন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত হন। আমন্ত্রণে হাজির হয়েছিলেন শহীদ মোবারকের মা-বাবাও। শহীদ মোবারকের বাবা জানালেন, এখন পর্যন্ত তাদের ৫ লাখ টাকা দিয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন। এর বাইরে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে ২ লাখ টাকা। আর কেউ খোঁজ নেননি। তিনি বলেন, ‘আমি একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের আমার ঘরটা দেখে যেতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু এখনও তাদের কেউ আসেনি।’