শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে নতুন কোনো শখ গড়ে তুলতে বা পুরোনো আগ্রহে সময় দিতে পারেননি বাংলাদেশের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর থেকে অন্ধকারের মুখে। আমার একটাই লক্ষ্য—বাংলাদেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। এখন আর কোনো শখ, খেলাধুলা বা বিনোদনের সময় নেই।’
৫১ বছর বয়সী এ সাবেক শিক্ষাবিদের দিনরাত কেটে যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। তিনি বলেন, ‘ঘুমের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। কখন ভোর হচ্ছে আর কখন সন্ধ্যা, কখনো কখনো বুঝতেই পারি না। সারাদিন শুধু কাজ, কাজ আর কাজ।’ তার মূল কাজ বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিকল্পনা করা এবং নির্বাসিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রাখা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় ১ হাজার ৩০০ শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রী নির্বাসনে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের এক সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্যের মতে, শুধু রাজনীতিবিদ নয়—সাংবাদিক, সিভিল সোসাইটির কর্মী, সেনা কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও কূটনীতিকরাও ‘মোহাম্মদ ইউনূস সরকারের নিপীড়নের ভয়ে’ দেশ ছেড়েছেন। তার হিসেবে এই সংখ্যা ২ হাজারের বেশি।
যারা ভারতে রয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই কলকাতার নিউটাউনে বসতি গড়েছেন। প্রশস্ত সড়ক, সুলভ অ্যাপার্টমেন্ট, শপিংমল, ফিটনেস সেন্টার এবং বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থান—সব মিলিয়ে এটি তাদের জন্য আদর্শ ঠিকানা হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ নেতা এ আরাফাত বলেন, ‘আমরা প্রিয়জনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। বাংলাদেশের মানুষ আরও ভালো কিছু প্রাপ্য এবং আমাদের দেশকে আবারও অঞ্চলের অর্থনৈতিক রত্নে পরিণত করতে হবে।’
নির্বাসিত জীবনের রুটিন
কক্সবাজারের এক সাবেক এমপি জানান, নির্বাসিত জীবনের একঘেয়ে রুটিন গড়ে উঠেছে। ভোরে ফজরের নামাজের পর তিনি পাশের জিমে যান, আর তার সহবাসী পিলাটিস ক্লাসে অংশ নেন। ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের ভাড়া মাসে ৩০ হাজার রুপি। তবে অনিয়মিত গৃহকর্মীর কারণে রান্নার ঝামেলা হয়, যা ভিডিও কলে ঢাকায় থাকা স্ত্রীকে দেখে শিখতে হচ্ছে। এমপি হাসতে হাসতে বলেন, ‘দেশে ফিরে হয়তো শেফ হয়ে যাব!’
দুপুরের পর অনলাইনে আওয়ামী লীগের দেশি–বিদেশি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। রাজনৈতিক খবরাখবর ভাগাভাগি করা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করাই এর উদ্দেশ্য।
ফজরের নামাজ, জিম সেশন বা সকালে হাঁটাহাঁটি করা, বাংলাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে প্রতি সন্ধ্যায় অনলাইন বৈঠক এবং ফিরে আসার আশা— এই চক্রেই কাটছে এসব নেতাদের জীবন।
বিশ্রাম নিতে আসিনি, বাঁচতে এসেছি
২০২৪ সালের ২ অক্টোবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে হঠাৎ করে তোলপাড় শুরু হয়। খবর ছড়িয়ে পড়ে—দেশটির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে কলকাতার বিখ্যাত বিনোদনকেন্দ্র নিক্কো পার্কে দেখা গেছে।
তিনি কীভাবে দেশ ছেড়েছেন তা কেউ জানেন না তখনও। তিনি কীভাবে দেশ থেকে অদৃশ্য হয়ে হঠাৎ কলকাতায় উপস্থিত হলেন ঢাকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেই ব্যাখ্যা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছিল। জুলাই–আগস্ট ২০২৪ অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের একাধিক মামলা দায়ের হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের একাধিক মন্ত্রী–সাংসদের মতো তার অবস্থানও ছিল রহস্যঘেরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব) শাহ আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। কেউ যদি নিয়ম মেনে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে যেতেন, তার প্রমাণ থাকত। তাদের ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ নেই। অনেকে অবৈধভাবে দেশ ছেড়েছেন, কেউ দেশে রয়ে গেছেন, আবার অনেককেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
নিউটাউনে বসবাসরত আওয়ামী লীগের এক সাবেক সংসদ সদস্য জানান, তিনি প্রায়ই খানের সঙ্গে দেখা করেন। তার ভাষায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমানে সেখানে একটি বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে থাকছেন এবং নিয়মিত দলের নেতা-কর্মীদের আতিথ্য দিচ্ছেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি দিল্লি যান—দলীয় বৈঠক এবং ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তার ছেলে সাফি মুদ্দাসসির খান জ্যোতি গ্রেপ্তার হন।
ওই সাবেক এমপির মতে, নির্বাসিত নেতাদের মনোবল ধরে রাখার দায়িত্ব পেয়েছেন কামাল। তিনি প্রতিদিন সহকর্মীদের মনে করিয়ে দেন— ‘আমরা এখানে বিশ্রাম নিতে বা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আসিনি। আমরা বাঁচতে এসেছি, যাতে আগামী দিনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি।’
গোপন অফিসের গুঞ্জন
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে দাবি ওঠে, কলকাতায় আওয়ামী লীগের একটি গোপন অফিস রয়েছে। তবে কক্সবাজারের ওই সাবেক এমপি বলেন, ‘হ্যা, নিউটাউনে একটি জায়গা ভাড়া নেওয়া হয়েছে যেখানে আমরা মিলিত হই, তবে এটাকে অফিস বলা অতিরঞ্জন। প্রায় ১ হাজার ৩০০ নেতা এখানে আছেন—সবাই কি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ড্রয়িংরুমে মিলিত হবেন!’
হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করে সময় কাটানো
ঢাকার এক তরুণ আওয়ামী লীগ এমপি নিউটাউনের ২বিএইচকে ফ্ল্যাটে একাই থাকা সময় কাজে লাগিয়ে হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করিয়েছেন। তিনি জানান, “ঢাকা থেকে পালানোর সময় আমার সামনের চুল পাতলা হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী কয়েক বছর ধরেই বলছিলেন হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে। কিন্তু প্রথমবারের এমপি হওয়ায় এত ব্যস্ত ছিলাম যে ঢাকায় সময় পাইনি।”
তিনি জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দিল্লির একটি হেয়ার ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টারে নিজের নতুন লুক তৈরি করেছেন। মজার ছলে তিনি বলেন, “এত কষ্টের সময়েও নতুন চুল পাওয়া এক ধরনের আনন্দের বিষয়।”